‘পেটের কথা কেউতো বলেনা’ (পেটস্তান আন্দোলনের গান)
ইতিহাস কখনো পুরনো হয়না। আর তার মধ্যে যদি কোন চিরকালীন সত্য লুকিয়ে থাকে তবে যথার্থ স্রষ্টার হাতে পড়লে তা মণিমানিক্য হয়ে উঠতে পারে। আজকের গানটি এমনই একটি সৃষ্টি। ১৯৪৭সালে স্বাধীনতার পর কয়েক লক্ষ মানুষ পশ্চিমবঙ্গ অথবা পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা পার হতে বাধ্য হয়েছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে। তাদেরই একজন ছিলেন দুই বাংলার শ্রদ্ধেয় লোক কবি নিবারণ পন্ডিত। ১৯৫০ সালে তিনি পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। কবির একান্ত অনুভূতি জন্ম দিয়েছিল এই অসাধারণ গানটির। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করার সময় সুখের যে খোয়াব দেখানো হয়েছিল তা অল্প সময়েই কেটে যায়। সবাই দেখলেন দুটো দেশ হল কিন্তু গরীব মানুষের পেটের কোন সুরাহা হলনা। এবার কবি বললেন হিন্দুস্তান পাকিস্তান যখন হল একটা পেটস্থান হোকনা যেখানে মানুষ খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে। অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় মার্কসবাদ তথা শ্রেণীসংগ্রামের মূল কথা এই গানটিকে এক অসামান্য উচ্চতায় উত্তীর্ণ করেছে। এই কারনেই প্রায় সত্তর বছর পরেও গানটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক প্রায় তিনশত গানের মধ্য দিয়ে নিবারণ পন্ডিত বাংলার লোকসঙ্গীতকে এক নতুন পথে পরিচালিত করেছিলেন। এর কোন জুড়ি নাই। তার সৃষ্টির যথার্থ মূল্যায়ণ আজও হয়নি।
‘কিনারায় ভিড়াইয়া বাইয়ো নাও’
লোকসঙ্গীত সমাজের ছবি আঁকে। তার চলমান ধারায় সাবলীল ভাবে উঠে আসে সমসাময়িক ছবি। এই ভাবেই শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন, ভাবনা আর লোকদর্শনকে শরীরে ঠাঁই দিয়েছে লোকসঙ্গীত। লোকসঙ্গীতের সুরের এত ক্ষমতা যে, সে তার সুরের অবয়বে প্রায় যে কোন বিষয় বা ভাবকে আশ্রয় দিতে পারে। এই গানটি শতকরা একশ ভাগ ভাটিয়ালী। কথায় বলে, ভাটিয়ালীতে ‘কানু ছাড়া গীত নাই’। তার বিপরীতে এবার এই গানটি শুনে দেখুন। ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে শৈশবে বাস করতেন লোককবি নিবারণ পন্ডিত। ১৯৪০ সাল নাগাদ ২৭/২৮ বছর বয়সে কবি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে আরম্ভ করেন। ১৯৪৩ সালে আসে ভয়াবহ মন্বন্তর। গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। দু মুঠো অন্নের অভাবে অথবা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে কলেরায় অজস্র মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেই শ্মশান হযে যাওয়া গ্রাম ছেড়ে অন্য অনেকের মত পালিয়ে আসছেন লোককবি। গ্রামের ধার দিয়ে নৌকায় আসার পথে ফেলে আসা গ্রামের দিকে চেয়ে রচিত এই গান। এই গানে উঠে এসেছে শৈশবের স্মৃতি, গ্রামের প্রতি ভালোবাসা, সন্তান হারানোর বেদনা আর তার সঙ্গে মিলে মিশে মন্বন্তর মহামারীর ছবি। এ এক অনন্য দলিল। জীবনকে কতখানি ভালবাসলে এমন গান রচনা করা যায়। যথার্থই লোকসঙ্গীতে নতুন ধারা এনেছিলেন লোককবি নিবারণ পন্ডিত!
‘আরে ও মোর বন্ধু দরদীয়া”
আরে ও মোর বন্ধু দরদীয়া বুঝি দেখ, কাঁয় বনাইল তোমাক নবীন বাউদিয়া। কোন দোষত গেইল তোর ভিটা মাটি বেচেয়া খাইলেক কুল্লে গয়নাগাঁটি রে কোন দোষত শেষ থালাবাটি, খাইলেক তুই বেচেয়া। কাঁয় হরিল তোর ক্ষেতের ধান কাঁয় কাড়িল তোর মুখের গান রে দুষমনক তুই না রাখালু চিনিয়া। ঐ পূর্ণ গোলাটা পূর্ণ হইল হাজার ভিটা শূণ্য হইল রে বুঝি দেখ, কাঁয় তোর বুকের রক্ত খাইলেক রে চুষিয়া। কি আছে তোর ভয় ডর বাঁচির বাদে লড়াই কর রে মরবি যদি মরি যা তুই বাঁচার লড়াই করিয়া। যাঁয় তোমাক নিত্তি মারে মুখের গ্রাস হরণ করে রে মূল দূষমনক বিনাশ কর তুই মরণ কামড় দিয়া। শব্দার্থ: কাঁয়-কে, দোষত-দোষে, বাঁচির বাদে-বাঁচার তরে, নিত্তি-নিত্ত, যাঁয়-যে,খাইলেক রে-খেল রে, রাখালু-রাখলি
‘বলি হোল কিরে হোল কি?’
বলি হোল করে হোল কি? দেশ জুড়ে লেগেছে একি রামঝুঁকি। দেশে হাওয়া উল্টা বয় কথা সবাই উল্টা কয় কেউ দিতেছে উল্টা করে আপন পরিচয় আবার কেউ বা আপন ঘর খুঁজিছে দেশের উল্টা ভাব দেখি। করো ভাঙলো মনের জোর কারো দুখের রাত্রি ভোর কেউবা দেখই মনউল্লাসে হয়েছে বিভোর আবার কেউ খেলতে চায লুকোচুরি মুখের মধুর ভাব রাখিরে।
জনদ্রোহী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে 30 ডিসেম্বর 2020 বাঘাযতীন মোড়ে অনুষ্ঠিত সংহতি জ্ঞাপক সভায় নিবারণ পণ্ডিত কর্তৃক রচিত ও সুরকৃত ‘আরে ওহ দেশবাসী…’ গানটি পরিবেশন করছেন সাম্পান সঙ্গীতগোষ্ঠীর সদস্যা অনন্যা নন্দী।